এম. মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্্ফার: আবহমানকাল থেকে মক্কায় অবস্থিত পবিত্র কাবাগৃহের হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কাবাগৃহকে মসজিদুল হারাম তথা বায়তুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর ঘর হিসেবে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনুল কারীমে এ ঘরটিকে পৃথিবীর মাটিতে নির্মিত প্রথম গৃহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন ‘নি:সন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে, সেটিই হচ্ছে এ ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা বিশ্বের মানুষের জন্য হেদায়াত ও বরকতময়।’ (সুরা আলে ইমরান- ৯৬)। এ আয়াতের ঘোষণা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, পবিত্র কাবা ঘরের প্রথম নির্মাণকারী হযরত ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন না, তিনি এটার পূন:নির্মাণকারী ছিলেন। কাবা ঘরের প্রথম নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.)। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পৃথিবীতে মানুষের বসতি স্থাপনের জায়গা নির্ধারণ করলে স্বভাবতই তাঁর কেন্দ্রীয় ইবাদত খানার প্রয়োজন দেখা দেয় সুতরাং সে কারনেই মক্কায় কাবা গৃহ নির্মিত হয় এবং আরাফাতের ময়দানসহ তৎসংলগ্ন মক্কা তথা আরব ভূখন্ডকে মানুষের জন্য কেন্দ্রীয় রাজধানী হিসেবে স্থিরকৃত হয়। পরবর্তীকালে হযরত নূহ (আ.) সহ অনেক পয়গম্বরগণের আমলে আল্লাহর দেয়া প্লাবন ও দূর্যোগের কারনে কাবাগৃহ ও তার চতুপর্¦াশের ভূমি বিরানে পরিণত হয় যা মুসলীম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীমের (আ.) দ্বারা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পূন:জীবিত করে তোলেন। এ প্রসঙ্গেঁ ঐ সময়ের কথা স্মরণ করা প্রয়োজন যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার নির্দেশে শিশু পুত্র ইসমাইল (আ.) ও তাঁর মাতা হাজেরাকে (আ.) মক্কার জনমানবহীন উসর মরুভূমিতে রেখে আসলেন এবং পরবর্তীতে সেখানে জনবসতি গড়ে উঠলো যাতে প্রাণছাঞ্চল্যময় শহরের গোড়াপত্তন হলো। আর আল্লাহ তায়ালার দিক নির্দেশনা মোতাবেক কাবা গৃহকে ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ.) পূন:নির্মাণ করলেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এভাবে বর্ণনা করেছেন ‘ঐ সময়ের কথা স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম এ বলে দোয়া করেছিল, হে আমার রব! এ শহরকে (মক্কা) তুমি নিরাপত্তার শহর বানাও আর আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তি পূজা থেকে দূরে রাখ। হে প্রভূ! ঐসব মূর্তি বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেছে, সুতরাং তাদের মধ্যে যে আমার প্রদর্শিত পথ অনুসরন করবে সে আমার পথ অনুসরনকারী হবে। যদি কেউ অমান্য করে তাহলে তুমি তো ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। প্রভূ হে! আমি একটি উসর মরু প্রান্তরে আমার সন্তানদের এক অংশকে তোমার মহিমান্বিত ঘরের পাশে এনে রেখে যাচ্ছি। হে রব! যাতে এখানে নামায প্রতিষ্ঠিত করে। সুতরাং ওদের প্রতি মানুষের মন আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদেরকে ফলমুলের খাদ্য দান কর যাতে তারা তোমার শোকরগোজার বান্দা হতে পারে।’ (সুরা ইব্রাহীম- ৩৫, ৩৬, ৩৭)। পবিত্র কুরআনুল কারীমের এ বর্ণনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার নির্দেশক্রমেই মুসলীম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) আরব উপদ্বীপের মক্কা নগরীকে কেন্দ্রস্থল করে গোটা বিশ্বে আল্লাহর দ্বীনের তাবলীগের মাধ্যমে ইসলামী সমাজ বিনির্মানের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ কাবাগৃহ নির্মাণের দ্বারা খালেসভাবে এক আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব ঘোষণার বিধান বাস্তবায়নই হলো আসল উদ্দেশ্য। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর সন্তান-সন্ততি এবং ধারাবাহিকভাবে তৎপরবর্তী বংশধরগণ জাতির পিতার রেখে যাওয়া এ সুন্নাতকে অনুসরন করে মানব জাতিকে এক আল্লাহর দাসত্ব ও আম্বিয়ায়ে কেরামগণের আনুগত্যের পথ নির্দেশনা খুঁজে পাবে, এটাই খানায়ে কাবা বিনির্মাণ ও এর হজ্ব চালু করার প্রকৃত উদ্দেশ্য তথা মহান লক্ষ্য।
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইলদ্বয় (আ.) কর্তৃক কাবাগৃহ পুন:নির্মাণ ও মহান রবের কাছে তাদের প্রর্থনার বিষয় কুরআনুল কারীমে এভাবে ঘোষণা করেছেন ‘স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম ও ইসমাইল কাবাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল, তারা দোয়া করেছিল: আমাদের রব! আমাদের দোয়া কবুল করুন, নিশ্চয়ই আপনি শ্রবণকারী সর্বজ্ঞ। পরওয়ার দেগার! আমাদের উভয়কে আপনার আজ্ঞাবহ করুন এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করুন, আমাদেরকে হজ্বের রীতিনীতি বলে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয় আপনি তওবা কবুলকারী, দয়ালু। হে পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী হিকমতওয়ালা।’ (সুরা বাকারা- ১২৭, ১২৮, ১২৯)। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ‘বায়তুল্লাহ’ অর্থাৎ কাবা কেন্দ্রিক মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই পৃথিবীর মধ্যস্থ ভূখন্ড মক্কাকে নির্দিষ্ট করে কাবা নির্মানের নির্দেশিকা জারী করেন। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আরো ঘোষণা করেন ‘পবিত্র স্থান কাবাকে আল্লাহ লোকদের জন্য আবাস ভূমি বানিয়েছেন….।’ (সুরা মায়েদা- ৯৭)।
একটি বিষয় অতি পরিষ্কার যে, যারা পবিত্র কাবার সংরক্ষণ এবং এ ঘরের প্রভূর দেয়া বিধান বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবে একমাত্র তারাই আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হিসেবে নেতৃত্বের অধিকারী হতে পারবে, তাছাড়া বিশ্বে খিলাফাতের দায়িত্বে কেউ-ই সমাসীন হবার যোগ্য হবে না। সে যত বড় অভিজাত তথা বংশগৌরবের শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করুক না কেন? এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘স্মরণ কর যখন ইব্রাহীমকে তাঁর রব বিশেষ কয়েকটি ব্যাপারে যাচাই করলেন এবং সব কয়টি ব্যাপারেই সে উত্তীর্ণ হলো, তখন তিনি বললেন আমি তোমাকে সকল মানুষের নেতা করতে চাই, ইব্রাহীম বললো- আমার বংশধরদের প্রতিও কি এ ওয়াদা? তিনি (আল্লাহ) বললেন আমার এ প্রতিশ্রুতি যালেমদের সম্পর্কে নয়।’ (সুরা বাকারা- ১২৪)। এ আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর ঘর কাবার আহবানের প্রতি অবজ্ঞাকারীদের জন্য যে লাঞ্চনা গঞ্জনা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা দিবালোকের মত সত্য। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এ কাবা ও তার নির্মাণকারী হযরত ইব্রাহীম (আ.) সম্পর্কে ঘোষণা করেন ‘ এ কথাও স্মরণ কর, আমি এ ঘরকে জনগণের জন্য কেন্দ্র, শান্তি ও নিরাপত্তার স্থানরূপে নির্দিষ্ট করেছিলাম এবং লোকদের এ নির্দেশ দিয়েছিলাম যে ইব্রাহীম যেখানে ইবাদতের জন্য দাঁড়ায় সে স্থানকে সালাতের জায়গারূপে গ্রহণ করো, ইব্রাহীম ও ইসমাইলকে তাগিদ করে বলেছিলাম যে, তাওয়াফ, ইতেকাফ ও রুকু সিজদাকারীদের জন্য আমার এ ঘরকে পবিত্র করে রাখো।’ (সুরা বাকারা- ১২৫)। এ আয়াতের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী যে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গঁম করা যায় তা হলো শান্তি ও নিরাপত্তার কেন্দ্র হিসেবে মক্কার কাবার অবস্থানের অর্থই হলো বিশ্বে যারা এ ঘরের মালিকের ইবাদত করবে এবং তাঁরই বিধান পৃথিবীতে বাস্তবায়ন করবে শান্তির অগ্রসৈনিক হিসেবে তারা সর্বক্ষেত্রে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হবে।
এখন যে বিষয়টি প্রশ্ন আকারে থেকে যায়, তা হলো যারা মহান রাব্বুল আলামীনের আদেশ নিষেধের পরিপন্থী কাজে লিপ্ত থাকবে এবং এ ঘরের প্রভূর ইবাদত করবে না ও এর যথাযথ সংরক্ষণ এবং এ গৃহের মর্যাদাকে ভুলুন্ঠিত করবে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সিদ্ধান্ত কী রয়েছে? এ সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা জাতির পিতার দোয়ার জবাবে পরবর্তী আয়াতে জানিয়ে দেন, ‘স্মরণ কর যে, ইব্রাহীম দোয়া করেছিল হে আমার রব! এ শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার নগর বানিয়ে দাও এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে মানে তাদেরকে সকল প্রকার ফলের রেযেক দান করো; জবাবে তাঁর রব বলেছেন- আর যে মানবে না, কয়েকদিনের এ জৈব জীবনের সামগ্রী তাকেও আমি দেবো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবো এবং উহা নিকৃষ্টতম স্থান।’ (সুরা বাকারা- ১২৬)। এ আয়াতের বক্তব্য অতি পরিষ্কার, কাজেই এর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মক্কায় কাবাগৃহ স্থাপন করলেও পৃথিবীর সকল মানুষ যারা এক আল্লাহকে রব হিসেবে মানে তাদের প্রবেশাধিকার সমান। যারা আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করবে তারা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধী। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন ‘যে সব লোক কুফরী করেছে আর যারা আল্লাহর পথ হতে লোকদেরকে ফিরিয়ে রাখছে এবং সে মসজিদে হারামের যিয়ারত হতে বাধা দান করছে যাকে আমি সমস্ত মানুষের জন্য বানিয়েছি, যাতে স্থানীয় বাসিন্দা ও বহিরাগতদের অধিকার সমান। এখানে যে লোকই সততার পথ পরিহার করে অন্যায় যুলুমের রীতি অবলম্বন করবে তাকে আমি কঠিন যন্ত্রনাদায়ক আযাবের স্বাদ গ্রহণ করাবো।’ (সুরা হজ্ব- ২৫)। আল্লাহর এ ঘোষণা দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর সৃষ্টি সকল মানুষের অধিকার সমান। শর্ত হলো একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করার অঙ্গীঁকার নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে।
পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বিশ্বনবীর (সা.) প্রতি যে নির্দেশ জারী করেছেন তা এ রকম ‘(হে নবী, এদেরকে বলো) আমাকে তো এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, আমি এ শহরের (মক্কার) রবের বন্দেগী করবো যিনি এটাকে হেরেম বানিয়েছেন এবং যিনি প্রত্যেকটি জিনিসেরই মালিক, আমাকে আদেশ করা হয়েছে যে, আমি মুসলীম হয়ে থাকবো।’ (সুরা নামল- ৯১)। এ আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে জানা গেল যে, কাবা কেন্দ্রীক মক্কা নগরী হলো মুসলীম জাতির প্রাণকেন্দ্র যার আবেদন হলো এক আল্লাহর বান্দাহ হিসেবে তাঁরই নিকট জবাবদিহিতার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে খানায়ে কাবার তাওয়াফ করতে হবে এবং আল কুরআনের আইন মানতে হবে ও বিশ্বনবীর সুন্নাতকে শক্তভাবে ধারন করতে হবে। মৃত্যুর পর মানুষ দুখন্ড সাদা কাপড় নিয়ে কবরে যায় ঠিক হজ্বের ইহরামের সময় মুসলমান দুখন্ড সেলাই বিহীন কাপড় পরিধান করে আল্লাহর ঘর কাবা গৃহ প্রদক্ষিণ করে থাকে যার মর্মার্থ হলো মানুষকে একদিন এভাবেই নি:স্বভাবে আল্লাহর দরবারে স্বীয় কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, তার সঙ্গীঁ হবে কেবলই নেক আমল।
মক্কার আত্ম-অহংকারী কোরায়েশরা কাবার কর্তৃত্বের জন্য পৃথিবীর বুকে দর্পভরে চলতো ও গর্ব করতো। কাবা গৃহের তত্ত্বাবধানের কারনেই তারা সারা দুনিয়ায় ব্যবসা বানিজ্য করতো এবং নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সুবিধা লাভ করতো। আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন ‘কাজেই তাদের কর্তব্য হলো এ ঘরের রবের ইবাদত করা।’ (সুরা কুরাইশ, ৩)।
সর্বশেষ কথা হলো কাবাগৃহের মালিক যে রাব্বুল আলামীন, জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার আদেশ নিষেধ মেনে তাঁর বিধান জমিনে বাস্তবায়নের চেষ্টার দ্বারাই কেবল আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব। আল্লাহ আমাদেরকে সে তাওফিক দান করুন- আমীন।
লেখক:
সদস্য দারুল ইসলাম ট্রাষ্ট
দরগাহ রোড, সিরাজগঞ্জ।
মোবাইল: ০১৭২৫-৭৩৫৩৯৯